মানব দেহের জন্য সুপারি কতটা ক্ষতিকর

মানব দেহের জন্য সুপারি কতটা ক্ষতিকর

পান-সুপারি আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত একটি আগত অতিথিদের প্রথমেই অভ্যার্থনামূলক বিশেষ কিছু হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে। দেশের অনেকেই এই পান-সুপারিতে এতটাই আসক্ত যে, অনেকটা নেশার মতই এগুলো গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু এই সুপারির অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। মানবদেহের জন্য সুপারি কতটা ক্ষতিকর আজকে আমরা তা জানতে চেষ্টা করবো।

সুপারি কি?

সুপারি গাছের ফল ডিম্বাকার থেকে গোলাকার, ছোট। কাঁচা ফলের রঙ সবুজ, পাকলে হলুদ বা কমলা রঙের হয়ে থাকে। সুপারি গাছের কাঁদিতে থোকা ধরে অনেক ফল থাকে। কাঁচা ও পাকা দু ধরণের সুপারি ফলই খাওয়া হয়। খোসা ছাড়িয়ে ভিতরে সুগোল যে বিচি থাকে সেটাই মূলত খাওয়া হয়। এই বিচি বা সুপারি শুকিয়েও খাওয়া হয়ে থাকে।

পাকা সুপারি

সুপারি বা Areca Nut নামে পরিচিত এটি এক ধরণের ফল। ফলটি এশিয়ার অনেক অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু সম্প্রদায়ে ব্যাপকভাবে চিবিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে।

যদিও পৃথিবীতে ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ সুপারি উৎপাদনকারী দেশ তথাপিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে সুপারি কোনোভাবেই স্বাস্থ্য সম্মত নয় বরং তা মানব দেহের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ বিষয়ে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ সতর্ক করেছেন।

কিভাবে সুপারি ব্যবহার করা হয়?

সাধারণত সুপারি চিবানো বিভিন্ন দেশে একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। সাধারণত একে উদ্দীপক এবং হজমে উপকারি বলে মনে করা হয়। সুপারি প্রায়শই পান নামক এক প্রকারের পাতার সাথে চিবিয়ে, তামাকের সাথে, অথবা পান পাতায় মুড়িয়ে, চুন এবং বিভিন্ন স্বাদযুক্ত পদার্থের সাথে মিশিয়ে দীর্ঘসময় ধরে চিবিয়ে এর রস খাওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সতর্ক থাকতে, ক্ষুধা নিবারণ করতে সুপারি ব্যবহার হয়। তবে মানব দেহে সুপারির রয়েছে ক্ষতিকর প্রভাব।

সুপারি বিচি

সুপারি চিবানোর তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যগত প্রভাব

সুপারি ব্যবহারকারীগণ প্রথমে সুপারি চিবানোর পরে এক ধরণের উষ্ণ অনুভূতি, হালকা উচ্ছ্বাস এবং মুখে লালা বৃদ্ধি অনুভব করেন। তবে স্বল্পমেয়াদী এ প্রভাবগুলির সাথে বেশ কিছু নেতিবাচক পরিণতিও এতে ঘটে থাকে।

হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি: সুপারিতে থাকা বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অ্যারেকোলিন নিকোটিনের মতো এক ধরনের উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে এবং এটি হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করতে পারে যা হৃদরোগের ঝুকি বাড়াতে বিশেষ অবদান রাখে।

অতিরিক্ত লালা এবং দাঁতে দাগ: অন্যান্য উপাদনসহ সুপারি চিবানোর ফলে মুখে অতিরিক্ত লালা উৎপন্ন হয় যাতে দাতে এবং মাড়িতে দীর্ঘস্থায়ী এক ধরণের দাগ পড়ে।

মুখের ঘা এবং জ্বালা: অধিক পরিমানের সুপারি গ্রহণকারীর মুখের ভিতর বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মুখের ঘা, জ্বালা এবং মাড়ির প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

আসক্তিকর বৈশিষ্ট্য: সুপারির রয়েছে আসক্তিকর গুণাবলী। ফলে অনেক ব্যবহারকারীর এতে আসক্তি তৈরি হয় যা ধূমপান ত্যাগ করার মতো কঠিন করে তোলে।

দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকি

নিয়মিত সুপারি খাওয়ার ফলে গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর কিছু দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে রয়েছে:

মুখের ক্যান্সার এবং ক্যান্সারের পূর্ববর্তী অবস্থা

সুপারি চিবানোর সবচেয়ে গুরুতর বিপদগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে মুখের ক্যান্সারের সাথে এর জোড়ালো সম্পর্ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সুপারিকে গ্রুপ ১ কার্সিনোজেন হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। এর অর্থ সুপারি মানবদেহে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে প্রমান পাওয়া গিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে সুপারি চিবানোর ফলে দেহে ক্যান্সারের পূর্ববর্তী অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যেমন:

Oral Submucous Fibrosis (OSMF): এটি এমন এক ধরণের অবস্থা যা মুখ শক্ত হয়ে যায়, চোয়াল খুলতে অসুবিধা হয় এবং মুখের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

Leukoplakia: মুখের ভিতরে সাদা দাগ সৃষ্টি হওয়া। যা সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।

Gastrointestinal সমস্যা

সুপারি মানব দেহে অ্যাসিড রিফ্লাক্স, গ্যাস্ট্রাইটিস এবং আলসারসহ হজমে নানা ধরণের ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। সুপারি গ্রহণের ফলে পেটের আস্তরণে জ্বালাপোড়া করে, যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হৃদরোগের ঝুঁকি

সুপারি চিবানো দেহে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সাথে বিশেষভাবে যুক্ত বলে বিজ্ঞানিগণ মনে করে থাকেন। এতে থাকা বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রভাব অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং হৃদযন্ত্রের উপর বিশেষ চাপ বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। যা হৃদরোগের ঝুকি বাড়িয়ে তোলে।

স্নায়বিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

সুপারি দীর্ঘমেয়াদী একজন ব্যবহারকারীর মেজাজের পরিবর্তন, উদ্বেগ এবং নির্ভরতার সমস্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিছু গবেষণায় দেখা যায় বয়স্কদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) এবং জ্ঞানীয় পতনসহ মানসিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির জন্য সুপারি দায়ী।

ডায়াবেটিস এবং বিপাকীয় ব্যাধি

গবেষণায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নিয়মিত সুপারি চিবানো ইনসুলিন প্রতিরোধের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে। এটি বিশেষ করে সেই জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক যেখানে ডায়াবেটিস ইতিমধ্যেই একটি প্রচলিত সমস্যা।

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিণতি

মানব দেহের জন্য সুপারি স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও এতে আসক্তির উল্লেখযোগ্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই অভ্যাসগতভাবে সুপারি গ্রহণের ফলে এর পেছনে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন। যা আর্থিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। সুপারি গ্রহণের ফলে এতে উৎপন্ন লালা যেখানে-সেখানে ফেলার কারণে সামাজিক পরিবেশ নোংড়া হয়ে থাকে। তাছাড়াও সুপারি ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

দাঁতের গর্ত প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।

সুপারি ত্যাগ করা কেন অপরিহার্য

সুপারি সম্পর্কিত আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য তথা সামাজিক উভয়ের জন্যই একে ত্যাগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আসক্তির কারণে এই অভ্যাস ত্যাগ করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবুও এখানে কিছু পদক্ষেপ দেওয়া হল:

সচেতনতা এবং শিক্ষা: সুপারির ক্ষতিকারক প্রভাব বুঝিয়ে এর ব্যবহারকারীদের এটি ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে।

চিকিৎসা সহায়তা: স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত পেশাদারদের সুপারি গ্রহণের প্রাথমিক লক্ষণগুলি প্রচার এবং মুখের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য সচেতন থাকা।

সুপারির বিকল্প: চুইংগাম বা অন্যান্য অ-ক্ষতিকারক বিকল্প খাদ্য-অভ্যাসে উৎসাহ প্রদান করা।

পারিবারিক সহায়তা: পরিবার এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে সুপারি ত্যাগে উৎসাহ প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নাবলী (FAQ)

সুপারি কি অবৈধ?

সুপারি অনেক দেশেই বৈধ কিন্তু স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে আবার অনেক দেশেই নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ। কিছু অঞ্চলে এর ব্যাপক ব্যবহার রোধ করার জন্য এর কেনা-বেচা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।

সুপারি কি হজমে সাহায্য করতে পারে?

কিছু লোক বিশ্বাস করে যে সুপারি খাদ্য হজমে সাহায্য করে থাকে। কিন্তু সুপারি গ্রহণে এর ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি সুবিধার চাইতে অনেক বেশি। এটি আসলে সময়ের সাথে সাথে হজমে সাহায্য করা তো দূরের কথা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (gastrointestinal) সমস্যা তৈরি করতে পারে।

কিভাবে সুপারি খাওয়া ছেড়ে দিতে পারি?

সুপারি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, চিকিৎসকের সহায়তা এবং এর বিকল্প অভ্যাস প্রয়োজন। একজন ডাক্তার বা আসক্তি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়া উপকারী হতে পারে।

সুপারি কি ক্যান্সার সৃষ্টি করে?

হ্যাঁ, সুপারি একটি পরিচিত কার্সিনোজেন (carcinogen)। এটি মুখের ক্যান্সার এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে দৃঢ়ভাবে জড়িত।

সুপারি খাওয়ার কি নিরাপদ কোন উপায় আছে?

না, সুপারি সহজাতভাবে ক্ষতিকারক এবং এর যেকোনো ধরণের সেবন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বহন করে। তাই সুপারি সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম বিকল্প।

সামান্য কিছু আনন্দ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও সুপারি উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে থাকে। নিঃসন্দেহে আমরা ধরে নিতে পারি মানব দেহের জন্য সুপারি কতটা ক্ষতিকর। যা এটি ব্যবহারের সুখানুভূতি চেয়ে ক্ষতির মাত্রা বেশি। মুখের ক্যান্সার থেকে শুরু করে হৃদরোগ এবং বিপাকীয় রোগগুলি সুপারি খাওয়ার ফলেই ঝুঁকি বাড়ায়।

তাই বর্তমানে যারা সুপারি খাচ্ছেন তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থ্যতার জন্য এক্ষনি এটি ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version