দাঁতের গর্ত সৃষ্টির কারণগুলো কি কি

দাঁতের গর্ত কেন হয়? এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

দাঁতের গর্ত যা Dental Caries বা দাঁতের ক্ষয় নামেও আমাদের নিকট পরিচিত। বিশ্বে প্রায় সকল বয়সের মানুষের জন্য এটি প্রচলিত সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। দাতের গর্ত সাধারণত একটি প্রতিরোধযোগ্য ব্যধি হিসেবে আমরা জানি। এখানে আমরা এই দাতের গর্ত কি? সাধারণত কি কারণে এটি হয়ে থাকে এবং কিভাবে একে প্রতিরোধ করা যায় তা জানতে চেষ্টা করবো।

দাঁতের গর্ত কি?

দাঁতের গর্ত বা Dental cavity হচ্ছে আমাদের দাঁতের সাদা-শক্ত অংশের ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ যা ছোট ছোট উন্মুক্ত অংশ বা ছোট ছোট গর্ত। এগুলো সাধারণত মুখের ব্যাকটেরিয়া, ঘন ঘন খাবার খাওয়া, চিনিযুক্ত পানীয় পান করা এবং মুখের স্বাস্থ্য রক্ষাকারী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বলতা সহ বিভিন্ন কারণে তৈরী হয়ে থাকে। গাঁতের এ গর্তসমূহ সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁতের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। যা দাতের ভিতরের স্তরগুলিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে থাকে এবং এক সময় এটি গুরুতর জটিলতা রোগের সৃষ্টি করে ফেলতে পারে।

দাঁতের গর্তগুলি যেকোনো দাঁতেই দেখা দিতে পারে। তবে সাধারণত এগুলি দাঁতের খাঁজে, দাঁতের মাঝখানে এবং মাড়ির রেখার কাছাকাছি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যদি দ্রুত এবং উপযুক্ত চিকিৎসা না করা হয় তাহলে দাঁতের একেবারে গোড়ায় গর্ত তৈরি হয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে থাকে।

দাঁতের গর্ত সৃষ্টির কারণগুলো কি কি?

দাঁতের গর্ত দীর্ঘদিন ধরে সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে ঘটে যাওয়া ব্যধি। যে সকল কারণে এটি ঘটে থাকতে পারে তার সম্ভাব্য কিছু কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

প্লাক গঠন (Plaque formation):

আমরা জানি আমাদের মুখে ক্রমাগত অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এদের মধ্যে কিছু উপকারী হলেও আবার কিছু ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াও থাকে। যখন কেউ চিনিযুক্ত বা স্টার্চযুক্ত খাবার গ্রহণ করে থাকে তখন আমাদের মুখের ব্যাকটেরিয়া এই কণাগুলিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং অ্যাসিড তৈরি করে থাকে। তাদের উৎপন্ন করা এ অ্যাসিডগুলি আমাদের মুখের লালা এবং দাতের ফাকে জমে থাকা খাদ্যের অবশিষ্টাংশের সাথে বিক্রিয়া করে প্লাক নামক একটি আঠালো স্তর তৈরি করে। এতেকরে দাতে প্লাক তৈরীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এসিড আক্রমণ (Acid attack):

প্লাক তৈরীর জন্য উপযুক্ত অ্যাসিডগুলি ধীরে ধীরে দাঁতের বাইরের স্তর তথা এনামেল (Enamel) এর ক্ষয় করে থাকে। এই এনামেল মানবদেহের সবচেয়ে শক্ত পদার্থগুলির একটি। কিন্তু এটি বারবার মুখে উৎপন্ন অ্যাসিড এর আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে বা সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পরে। ফলে দাতে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ক্ষত ছড়িয়ে পরা

প্রাথমিক অবস্থায় তৈরী দাঁতের গর্তের চিকিৎসা না করা হয় এই ক্ষয় দাঁতের পরবর্তী ভেতরের স্তরে ছড়িয়ে পরে। যাকে ডেন্টিন (Dentin) বলা হয়। ডেন্টিন এনামেলের চেয়ে নরম এবং দ্রুত ক্ষয়যোগ্য একটি স্তর। একবার দাতের ক্ষত ডেন্টিন স্তরে পৌঁছালে এটি আরও দ্রুত অগ্রসর হতে পারে এবং দাঁতের গর্তের এ পর্যায়ে দাঁত ব্যথার কারণ হতে পারে।

পাল্প ড্যামেজ (Pulp Damage)

উপরোক্ত অবস্থা আরও গভীর পর্যায়ে অর্থাৎ দাঁতের পাল্পে পৌঁছাতে পারে। যেখানে দাতের স্নায়ু এবং রক্তনালী থাকে। এ স্তরে ক্ষতের সৃষ্টি হলে তীব্র দাঁত ব্যথা, মাড়ি ফোলাভাব এবং এটি আরও অতি দ্রুত অপর দাঁতে সংক্রমিত হতে পারে। পর্যায়ে দাঁতের Root canal এর মতো বড় আকারের দাঁতের চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

যে সকল কারণে দ্রুত দাঁতে গর্ত সৃষ্টি হতে পারে

যদিও দাঁতে গর্ত হবার অসংখ্য কারণ থাকতে পারে তারপরও নিম্নে উল্লেখিত কিছু কারণ দাতে দ্রুত গর্ত সৃষ্টি করতে পারে। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লস (floss) না করা হলে এটি দাতে প্লাক তৈরি করে দ্রুত দাঁতের এনামেলকে আক্রমণ করে দাতের ক্ষতি করে থাকে।

চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ: ঘন ঘন চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ, সোডা এবং কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাদ্য দাতে গর্ত সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা বাড়িয়ে তোলে ফলে দাঁতে গর্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

শুষ্ক মুখ: মানবদেহের মুখের লালা অ্যাসিডকে অকার্যকর করতে এবং খাদ্য গ্রহণ পরবর্তী দাতের ফাকে থাকা খাদ্য কণা ধুয়ে ফেলতে সাহায্য করে। কিন্তু মুখের অভ্যন্তরে শুষ্কভাবে বজায় থাকলে দাতের গর্ত বৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

Acid reflux বা ঘন ঘন বমি: মাবনদেহে খাদ্য হজম করার অ্যাসিড ঘন ঘন বমি করার ফলে তা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে। যা দাঁতকে ক্ষয় তথা দাতের গর্ত সৃষ্টির জন্য সহায়তা করতে পারে।

বয়স: শিশু এবং বয়স্কদের দাতের দুর্বল এনামেল এর কারণে দাতে গর্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।

দাঁতের গর্তের লক্ষণ সমূহ

প্রাথমিক পর্যায়ে দাঁতের গর্তের কোনও সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা নাও দিতে পারে। তবে দাঁতের ক্ষত যত এগিয়ে যাওয়ার কিছু লক্ষণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

  • গরম, ঠান্ডা বা মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং পানি পানের সময় দাঁতের শিহরণ অনুভব করা।
  • আক্রান্ত দাঁতে সম্ভাব্য দৃশ্যমান গর্ত বা গর্ত গর্ত ভাব।
  • সময়ে সময়ে দাঁতে ব্যথা বা একটানা দীর্ঘ ব্যথা।
  • এক বা একাধিক দাঁতের পৃষ্ঠে বাদামী, কালো বা অস্বাভাবিক দাগ।
  • দাঁত দিয়ে কোন খাদ্য-সামগ্রী কামড়ানোর সময় ব্যথা।

যদি কোন ব্যক্তি উপরের এই লক্ষণগুলির যে কোনোটি অনুভব করে থাকে তবে আরও অধিক ক্ষতি রোধ করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন অভিজ্ঞ দাঁতের ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত।

কিভাবে দাঁতের গর্ত প্রতিরোধ করবেন?

সঠিক উপায়ে এবং সঠিকভাবে মুখের যত্ন এবং কিছু কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা সহজেই দাতের গর্ত প্রতিরোধ করতে পারি। দাঁতের গর্তসহ দাতের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এখানে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল।

নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা

দিনে দুইবার সকালে খাবার পর এবং রাত্রে খাবার গ্রহণের পর প্রতিবার অন্তত দুই মিনিট ধরে দাঁত পরিষ্কার করার জন্য ফ্লোরাইড টুথপেস্ট এবং নরম ব্রিস্টলযুক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করা। নিয়মিত ব্রাশ করলে দাতের প্লাক এবং দাঁতের ফাকে জমা খাবারের কণা দূর হয়ে দাঁতের ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে।

প্রতিদিন ফ্লস করা

নিয়মিত ফ্লসিং করা হলে দাঁতের মাঝখানের, মাড়ির রেখা বরাবর প্লাক এবং খাবারের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করা সহজ হবে। দাঁতের যে অংশে আপনার টুথব্রাশ পৌঁছাতে পারে না তা নিয়মিত ফ্লসিং করে পরিস্কার রাখা সম্ভব।

চিনিযুক্ত এবং অ্যাসিডিক খাবার সীমিত করা

যতটা সম্ভব চিনিযুক্ত খাবার, সোডা এবং অ্যাসিডিক জাতীয় পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি একান্তই খাদ্যগুলি গ্রহণ করে থাকেন তবে পর্যাপ্ত পানীয় দ্বারা তা ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া উচিত।

ফ্লোরাইডযুক্ত পানি পান করা

গবেষণায় প্রমানিত যে, ফ্লোরাইড দাঁতের এনামেলকে শক্তিশালী করে এবং দাঁতের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। তাই আমাদের ফ্লোরাইডযুক্ত পানি পান করা উচিত। বেশিরভাগ টিউবওয়েল এর পানিতে ফ্লোরাইড থাকে। তাই আমাদের প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত।

সকালে খালি পেটে পানি পানের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।

চিকিৎসা গ্রহণ

দাঁত তথা মুখের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা দাঁতের পরীক্ষা করানো উচিত। বিশেষ করে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার আক্রান্ত দাঁতের গর্তের প্রাথমিক লক্ষণগুলি সনাক্ত করতে পারলে এর থেকে দ্রুত প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

তাই দাঁতের তুলনামূলক ক্ষতি রোধ করার জন্য প্রাথমিকভাবে দাঁতের গর্ত সনাক্তকরণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিয়মিত দাঁতের পরীক্ষা একজন দন্ত চিকিৎসককে প্রাথমিক পর্যায়ে দাঁতের গর্ত সনাক্ত করতে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। দাঁতের যে কোন ধরণের অসুস্থ্যতা জনিত চিকিৎসায় গাফিলতি করলে ভবিষ্যতে এই অসুস্থ্যতা আরও অন্যান্য দাতে এবং অনেকটা ব্যয়বহুল চিকিৎসায় পরিণত হতে পারে। তাই দাঁতের যত্নে কোন অবহেলা করা ঠিক হবে না।

তাই এখনই দাঁতের যত্ন নেওয়া শুরু করুন। নিয়মিত ব্রাশ, ফ্লস এবং মুখের তথা দাঁতের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version