ক্রিপ্টোকারেন্সি কি এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে কি হয়, এর সুবিধা ও অসুবিধা

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে কি করা হয়?

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? বিষয়টি বেশ কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে উঠতি বয়সের তরুন-রা Cryptocurrency বিষয়ে বেশ আগ্রহী। ডিজিটাল এ সিস্টেমটি সম্পর্কে এখানে আজ আমরা জানতে চেষ্টা করব ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে কি করা হয়? ক্রিপ্টোকারেন্সি কিভাবে কাজ করে? ক্রিপ্টোকারেন্সির সুবিধা ও অসুবিধা ইত্যাদি।

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি (What is Cryptocurrency)

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে এটি এক ধরণের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা। আমরা জানি পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য যে মুদ্রা নীতি প্রচলিত রয়েছে তা কাগজের অথবা কোন ধাতুর তৈরী। অপরদিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency) হচ্ছে ডিজিটাল বিনিময় মাধ্যম। ১৯৮৩ সালে চালু হওয়া ভার্চুয়াল মুদ্রা যা প্রথমের দিকে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও বর্তমানে পৃথিবী ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগে প্রবেশ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি হচ্ছে এক ধরণের Private Digital Currency। ক্রিপ্টোকারেন্সি নতুন এক ধরণের লেনদেনের মাধ্যম। আমরা ক্রিপ্টোকারেন্সি কে এক প্রকার digital Currency of Cash ও বলতে পারি। ক্রিপ্টোকারেন্সি শব্দের Crypto শব্দটির অর্থ হচ্ছে secret বা গোপন এবং Currency শব্দ বলতে বুঝায় অর্থ। যার দ্বারা প্রচলিত অর্থের মতই ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময় করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরণের Encrypted Currency যার ফলে এর লেনদেন পুরোপুরিভাবে গোপন থাকে। এর উপর কোনো তৃতীয় ব্যক্তির হাত থাকে না এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এতে কোন দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার উপায় থাকে না।

যেহেতু ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিজিটাল এক সিস্টেম তাই আপনি একে কখনই হাতে নিয়ে স্পর্শ করে দেখতে পারবেন না। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে আপনি অনলাইনে লেনদেন করতে পারবেন। আর একটি মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের পৃথিবীতে যেমন একেক দেশের অর্থের এক এক ধরণের মান কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে তেমনটি হয় না। অর্থাৎ পৃথিবীর সবখানেই এর মান একই।

ক্রিপ্টোকারেন্সি এর ইতিহাস (History of Cryptocurrency)

১৯৮৩ সালে মার্কিন ডেভিড চৌম নামক এক ব্যক্তি ডিজিটাল উপায়ে অর্থ লেন-দেন বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি এর নাম দেন ই-ক্যাশ। ১৯৯৫ সালে, তিনি ডিজিক্যাশের মাধ্যমে ডিজিটাল সিস্টেমে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থার একটি প্রাথমিক রূপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে থাকেন। তবে সাতোশি নাকামোতো (Satoshi Nakamoto) সফলভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থা বিহীন ডিজিটাল নগদ অর্থে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা চালু করতে সফল হয়েছিলেন। তিনি বিটকয়েন এর আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সময় থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচলন শুরু হয় এবং দিনের পর দিন এই ক্রিপ্টোকারেন্সি এর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে ।

ক্রিপ্টোকারেন্সি কিভাবে কাজ করে (How Cryptocurrency Works)

আমরা ইতিমধ্যে জেনেগেছি ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম। এই সিস্টেমের একটি অংশ হচ্ছে প্রকৃত মুদ্রা এবং দ্বিতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক যা এই ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন সমর্থন করে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনগুলি একটি ক্রিপ্টো ওয়ালেট এর সাথে একত্রে কাজ করে এবং এতে পাবলিক ও প্রাইভেট কী বা পাসওয়ার্ড জাতীয় তথ্য থাকে। এই কীগুলি বা এ তথ্য দ্বারা একজন ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট সনাক্ত করা হয়ে থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সি লেন-দেনের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই প্রথমে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য তাদের ওয়ালেট কীগুলি বিনিময় করে এবং তারপর একটি লেনদেন শুরু করে যা ব্লকচেইন এ রেকর্ড করা হয়। লেনদেন প্রক্রিয়াটি বিশেষ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে এবং জটিল ক্রিপ্টোগ্রাফিক গণিতের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

এই ব্লকচেইন প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করে যে সমস্ত লেন-দেন নিরাপদ রয়েছে। সেই সাথে ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিজিটাল মুদ্রার জন্য একটি সার্বজনীন পদ্ধতির ব্যবস্থাও করে, যা ক্রিপ্টোকারেন্সি এর সীমাবদ্ধতা ছাড়াই যে কোনও জায়গায় কাজ করতে সক্ষম করে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি এর মান কেমন

এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে, ক্রিপ্টোকারেন্সি কোন ছাপানো কাগজের নোট বা বাস্তবে তৈরী করা কোন কয়েন নয়। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর একটি নির্দিষ্ট মান, মূল্য বা ভ্যালু রয়েছে। এটি ডিজিটাল আকারে অনলাইনে থাকায় একে ডিজিটাল মানি, ভার্চুয়াল মানি, ডিজিটাল ক্যাশ বা ইলেক্ট্রনিক মানিও বলা হয়ে থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে আপনি পণ্য কেনাবেচা, এক ওয়ালেট হতে আর এক ওয়ালেট-এ আদান-প্রদান করতে পারবেন। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি-কে ব্যাংকে বা লকার বা আপনি আপনার সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন না।

ক্রিপ্টোকারেন্সি এর যে ভ্যালু বা মান রয়েছে তা অন্যান্য দেশীয় কারেন্সি এর মানের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। ডলারের থেকেও অনেক গুণ বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি এর ভ্যালু। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর মান সবসময়ই পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। এর মান সর্বদা উঠানামা করে থাকে। এ জন্য একই দিনে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর মান বিভিন্ন হতে পারে।

কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি এর পরিচয়

বর্তমান সময়ে বেশ কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচলিত রয়েছে। তবে সব থেকে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি হচ্ছে “বিটকয়েন (Bitcoin)”। তবে বিটকয়েন ছাড়াও মার্কেটে আরও অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। স্বল্প আকারে কিছু শীর্ষ জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি এর পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো।

বিটকয়েন (Bitcoin)

২০০৯ সালে বিটকয়েন Satoshi Nakamoto নামক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বিটকয়েন বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এটি সব থেকে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বর্তমানে সবথেকে বেশি ব্যয়বহুল ডিজিটাল মুদ্রা হচ্ছে বিটকয়েন এর মূল্য একেবারে আকাশছোঁয়া। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে BTC।

ইথেরিয়াম (Ethereum)

২০১৫ সালে প্রথম ইথেরিয়াম চালু করা হয়। ইথেরিয়াম হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক। আগে ইথেরিয়াম এর মূল্য বা মান খুব বেশি ছিল না। তবে বর্তমানে ইথেরিয়াম এর মানও ধীরে ধীরে বাড়ছে। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ETH।

লাইট কয়েন (Light Coin)

২০১১ সালের চার্লি লি প্রথম এই লাইট কয়েন চালু করেন। যিনি গুগলের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও কাজ করেছিলেন। লাইট কয়েন সবচেয়ে দ্রুততম লেনদেন এর জন্য পরিচিত ছিল। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে LTC।

বাইন্যান্স কয়েন (Binance Coin)

বর্তমানে খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাইন্যান্স কয়েন। এই কয়েন দিয়ে আপনি সহজেই ভ্রমণের জন্য ট্রেন উড়োজাহাজ বুকিংসহ সহ ট্রৈডিং ও করতে পারবেন। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে BNB।

ডগিকোয়েন (Doge Coin)

এ কয়েনটিতে কুকুরের ছবি ব্যবহার করে লোগো তৈরী করা বলে এর নাম ডগিকয়েন। এর উপর কুকুরের ছবি থাকায় এটি সকলের কাছে একটি মিম এ পরিণত হয় এর ফলে টেসলা কোম্পানির মালিক ইলন মাস্ক এর সহায়তায় এর মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এটিও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে DOGE।

কার্ডানো (Cardano)

কার্ডানো হচ্ছে আরও একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি। কার্ডানো কারেন্সি-ও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এবং এর মান ক্রমে বেড়েই চলেছে। এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ADA।

এছাড়াও মার্কেটে আরও অনেক ধরণের ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচলিত রয়েছে। যেমন- XRP, Bitcoin Cash, TRON, Solana, Bitcoin SV ইত্যাদি।

ক্রিপ্টোকারেন্সি এর সুবিধা ও অসুবিধা

প্রায় প্রতিটি জিনিসের সুবিধা ও অসুবিধা এ দুটি দিক থাকে। এক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকারেন্সিও এর ব্যতিক্রম নয়। নিম্নে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।

সুবিধা

দিনে দিনে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর ব্যবহার বা জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। নিম্নে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর কিছু সুবিধা তুলে ধরা হলো।

  • ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ায় এটি জাল বা বিকৃত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
  • ডিজিটাল মুদ্রা হবার কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাপানোর খরচ নেই।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাতে বেশি সময় ব্যয় হয় না।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি এর কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান না থাকায় এর কোন নির্দিষ্ট শর্ত বা নির্দেশাবলীর ঝামেলা নেই।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি আদান-প্রদানে কোন চার্জ কাটা হয় না।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি-কে আপনি বিশেষ ATM Card এর মাধ্যমে টাকায় রূপান্তরিত করতে পারবেন।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি কোন গোষ্ঠী বা সরকার ব রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ এর মূল্য বা মান বৃদ্ধির হার অনেক বেশী।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কোন ব্যাংকের প্রয়োজন হয় না ।

অসুবিধা

এবারে চলুন জেনে নেই ক্রিপ্টোকারেন্সি এর অসুবিধাগুলি কি কি।

  • ক্রিপ্টোকারেন্সি কোন সরকার বা রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না বলে এর মূল্য বা মান খুব বেশী উঠা-নামা করে থাকে।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ায় এতে হ্যাক হওয়ার সীমিত সম্ভাবনা রয়েছে।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সির কোন বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি ভুলকরে আদান-প্রদান হয়ে গেলে তা আর পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি কিছু কিছু দেশের সরকার বৈধতা দেয় না।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার সীমিত।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে অবৈধ কার্যকলাপ পরিচালিত হতে পারে।

পরিশেষে আশা করছি আপনি ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারণা পেয়েছেন। আমরা আমাদের অজান্তে ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগে আমরা প্রবেশ করে ফেলেছি। তাই আমাদের জীবন থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি-কে দূরে রাখতে পারছি না। আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি-কে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞগণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version