আমরা জানি হৃদরোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এ রোগে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। “হৃদরোগ” বলতে হার্ট এর বিভিন্ন অসুস্থ্যতার অবস্থাকে বুঝায়। এতে রয়েছে coronary artery disease (CAD), হার্ট ফেইলিওর, অ্যারিথমিয়া এবং হার্টের ভালভ সমস্যা। মানবদেহে হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ সনাক্ত করা গেলে তা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। কারণ এতে করে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহনের মাধ্যমে হার্ট সুস্থ রাখা সম্ভব হতে পারে।
Table of Contents
এখানে আমরা হৃদরোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ বিষয়ে বিস্তারিত এবং কখন চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করবো।
হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ
হৃদরোগের লক্ষণ সাধারণত একজন ব্যক্তির এ রোগের ধরণের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। এ বিষয়ে কিছু সাধারণ সতর্কতামূলক লক্ষণ নিম্নে দেওয়া হল:
বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা
হৃদরোগের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা। এতে বুকে চাপ অনুভব করা বা বুক জ্বালাপোড়া হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। হৃদপেশী পর্যাপ্ত অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত না পাওয়ার ফলে এ সমস্যাটির সৃষ্টি হয়। এ লক্ষণ সাধারণত করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) এর ক্ষেত্রে দেখা যায়। একটু শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সাথে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার সাথে এটি আবার কমেও যেতে পারে।
শ্বাসকষ্ট
হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ এর মধ্যে বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময়ে অথবা শুয়ে থাকার সময়ে শ্বাসকষ্ট হওয়া হৃদরোগজনিত অসুস্থ্যতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হতে পারে। সাধারণত হৃদযন্ত্র সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে পরিচালনা না করতে পারার কারণে এমনটি হতে পারে। এ অবস্থায় ফুসফুসে তরল জমতে থাকে। যার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ক্লান্তি
এ ধরণের লক্ষণে সাধারণত বিশ্রাম নেবার পরও অস্বাভাবিক এবং অবিরাম ক্লান্তি অনুভব করা অপর একটি হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ। এই লক্ষণটি প্রায়শই মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়। রক্তনালী সংকীর্ণতার কারণে হৃদযন্ত্রের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে তথা দুর্বল রক্তসঞ্চালন হবার কারণে এই লক্ষণ প্রকাশ পায়।
অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (অ্যারিথমিয়া)
অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা সঠিকভাবে হৃদস্পন্দন না হওয়া অথবা দ্রুত হৃদস্পন্দন Arrhythmia রোগের লক্ষণ। এ ধরণের পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক মনে হলেও ঘন ঘন এ ধরণের লক্ষণ হৃদযন্ত্রের গুরুতর অসুস্থ্যতার ইঙ্গিত হতে পারে।
পায়ে ফোলাভাব
Heart failure এর কারণে দেহের নিম্ন অঙ্গে পানি জমতে শুরু হতে পারে। এ কারণে হৃদযন্ত্র সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করার পরও তা করতে না পারার ফলে দেহের নিচের অংশে পানি জমাতে শুরু করে থাকে।
মাথা ঘোরা ঘোরা ভাব
হৃদরোগের কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সময়ে সময়ে মাথা ঘোরা, বা মাথা ঘোরা ঘোরা ভাব হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে এই লক্ষণগুলো যদি হঠাৎ হঠাৎ ঘটে থাকে। এই লক্ষণগুলি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, নিম্ন রক্তচাপ, অথবা তুলনামূলক দুর্বল রক্ত সঞ্চালনের কারণেও হতে পারে।
ঘাড়, চোয়াল, পিঠ বা হাতের বাহুতে ব্যথা
যদিও বুকে ব্যথা হৃদরোগের একটি প্রধান লক্ষণ তারপরও অস্বাভাবিকভাবে ঘাড়ে অস্বস্তি বোধ করা অথবা ব্যাথা অনুভব করা, চোয়াল, পিঠ বা হাতের বাহুতেও ব্যাথা ছড়িয়ে পরা এই রোগের ইঙ্গিত করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি অনুভূত হয়ে থাকে।
ঠান্ডা ঘাম এবং বমি বমি ভাব
হঠাৎ করেই ঠান্ডা ঘাম, বমি বমি ভাব বা বমি করা, বিশেষ করে যখন একইসাথে বুকেও ব্যথা অনুভব হয়ে থাকে তখন এটি হার্ট অ্যাটাকের ইঙ্গিত মনে করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলি বেশি দেখা যায়।
বদহজম
হৃদরোগে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তি তাদের এ লক্ষণগুলিকে বদহজম বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স বলে ভুল করে থাকে। যদি এ ধরণের লক্ষণগুলি ঘন ঘন দেখা যায়, বিশেষ করে অন্যান্য সতর্কতামূলক লক্ষণগুলির সাথে তবে এটি হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
স্বাস্থ্য এবং আরামদায়ক ঘুমের জন্য ভালো বালিশের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
হৃদরোগ ঝুঁকির কারণ
হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলির দিকে নজর দেয়া একজন ব্যক্তির হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগের অসংখ্য কারণ থাকতে পারে। যা একজন উপযুক্ত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করতে সক্ষম। তারপরও এখানে সম্ভাব্য কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো।
উচ্চ রক্তচাপ – হৃদপিণ্ড এবং ধমনীর উপর চাপ বৃদ্ধি করে।
উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা – রক্তবহনকারী ধমনীতে প্লাক জমিয়ে দেহে রক্ত প্রবাহের পথ চিকন করে।
ডায়াবেটিস – হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকি অধিক মাত্রায় বাড়ায়।
ওজন – অতিরিক্ত দেহের ওজন হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
ধূমপান – রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে।
শারীরিক পরিশ্রম – ব্যায়ামের অভাব হৃদযন্ত্রকে ক্রমে দুর্বলতার দিকে নিয়ে যায়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস – বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
বংশগত – বংশগতভাবে হৃদরোগ নতুন প্রজন্মে ভূমিকা রাখে বলে প্রমান পাওয়া গেছে।
মানসিক চাপ – দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদরোগের ঝুকি অনেকাংশে বাড়াতে পারে বলে চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত
আপনার যদি উপরে উল্লিখিত যে কোনও লক্ষণ, বিশেষ করে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা পা ফোলাভাব অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। একজন মানুষের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো গুরুতর অসুস্থ্যতা প্রতিরোধ করার জন্য হৃদরোগের লক্ষণগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা গেলে এটি নিরাময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে যদি আপনার বা আপনার আশেপাশের কেউ নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি তাৎক্ষণিক অনুভব করেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
• কয়েক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে তীব্র বুকে ব্যথা
• বাহু, পিঠ বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে
• তীব্র শ্বাসকষ্ট
• ঠান্ডা ঘাম, বমি বমি ভাব, বা বমি
• হঠাৎ মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
হৃদরোগের জন্য উপরে বর্ণিত উপসর্গগুলি ছাড়াও আরও নানা ধরণের লক্ষণ রয়েছে। এ লক্ষণগুলি কখনও কখনও অনেকটা সূক্ষ্ম হতে পারে বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা বলে ভুলও হতে পারে। সুস্থ্যতার জন্য সতর্কতা লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং জীবনমান পরিবর্তন এবং উপযুক্ত চিকিৎসকের নিয়মিত চেক-আপের মাধ্যমে হৃদরোগ ঝুঁকির কারণগুলির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে যে কেউ হার্টের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেন।
মনে রাখবেন আপনার হার্টের স্বাস্থ্য আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের লোকজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজে সচেতন থাকুন এবং অন্যকেও সচেতন রাখতে সহায়তা করুন।